যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের ক্রমবিকাশ 2023

Posted on
Advertisement
Reading Time: 4 minutes

শিক্ষাক্রমের ধারণা ও যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পরিমার্জনের ক্রমবিকাশঃ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষাক্রম সম্পর্কে ধারণা এবং বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ভিত্তিক পরিমার্জনের ক্রমবিকাশ নিয়ে আজ বিস্তারিত আলোচনা করবো। আজ আমরা জানবো শিক্ষাক্রম কি, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ২০২৩ ও পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সমূহ। 

সংজ্ঞাঃ শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড আর পদ্ধতিগত শিক্ষার ভিত্তি হলো শিক্ষাক্রম ।

শিক্ষাবিদগণ বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাক্রমের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন

শিক্ষাক্রমের ধারণা

টাইলার শিক্ষাক্রমের সংজ্ঞা সরাসরিভাবে প্রদান না করে চারটি প্রশ্নের মাধ্যমে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যেমন:

* শিক্ষা কী কী উদ্দেশ্য অর্জন করবে,

* কী কী শিখন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিদ্যালয় এসব উদ্দেশ্য অর্জন করবে,

* কীভাবে শিখন অভিজ্ঞতাগুলো সংগঠন ও বিন্যাস করা যাবে,

* উদ্দেশ্যগুলো অর্জিত হয়েছে কিনা তা কীভাবে যাচাই করা যাবে।

হুইলার  শিক্ষাক্রম বলতে শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু নির্বাচন, বিষয়বস্তু শনাক্তকরণ, বিষয়বস্ত সংগঠন, মূল্যায়ন ইত্যাদির একটি বৃত্তাকার গতিশীল প্রক্রিয়াকে বুঝিয়েছেন।

কার শিক্ষাক্রম বলতে বিদ্যালয় কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত যাবতীয় শিখন যা বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের বাইরে দলগত বা ব্যক্তিগতভাবে সম্পন্ন করা হয়, তাই শিক্ষাক্রম ।

সেলর ও আলেকজান্ডার শিক্ষাক্রম বলতে শ্রেণিকক্ষে, খেলার মাঠে বা বিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের শিখনকে বুঝিয়েছেন। 

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়-যুক্তরাজ্য শিক্ষাক্রম বলতে বুঝিয়েছেন- শিক্ষায়তনে শিক্ষা গ্রহণকালে বিভিন্ন রকম সুবিন্যস্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে সামাজিকভাবে জ্ঞান, দক্ষতা এবং মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভজি বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় তাই শিক্ষাক্রম ।

শিক্ষাক্রম পরিমার্জন

ডেলর কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী জীবনব্যাপী শিক্ষা চারটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, স্তন্তগুলো হচ্ছে – জানার জন্য শিখন কাজের জন্য শিখন, মিলেমিশে বসবাস করার জন্য শিখন এবং বিকশিত হয়ে উঠার জন্য শিখন, এই চারটি স্তভের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন করা হয়ে থাকে ।

শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একটি নিয়মিত ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম । সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও নবায়ন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। 

এই উদ্দেশ্যে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৬ সালে একটি দীর্ঘ মেয়াদী ও বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে । এই সময়ে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে প্রাথমিক স্তরের জন্য যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই শিক্ষাক্রম ১৯৮৮ সালে চূড়ান্ত করা হয়। দেশব্যাপী ১০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক ট্রাই-আউট পরিচালনার নিমিত্ত শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের মাধ্যমে উপযোগিতা যাচাই করা হয়।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দেশের সকল বিদ্যালয়ে প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়। সময়ের পরিক্রমায় বৈশ্বিক পরির্বতনের প্রেক্ষিতে বর্তমান শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ : প্রাক – প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি 

শিক্ষাক্রমের মূলনীতি শিক্ষাক্রম রূপরেখার রূপকল্প ,অভিলক্ষ্যসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন ও অনুসরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে অর্জন নিশ্চিত করতে দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কিছু মূলনীতি সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে যা এই শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে , সেগুলো হলো :

  • মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ
  • একীভূত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক
  • বৈষম্যহীন
  • বহুমাত্রিক
  • যোগ্যতাভিত্তিক
  • সক্রিয় ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন
  • প্রাসঙ্গিক ও নমনীয়
  • জীবন ও জীবিকা – সংশ্লিষ্ট
  • অংশগ্রহণমূলক
  • শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আনন্দময়

রূপকল্প

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক ,উৎপাদনমুখী ,অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা । ‘

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ,জাতীয় ইতিহাস , ঐতিহ্য , সংস্কৃতি লালনকারী সৎ ,নৈতিক , মূল্যবোধসম্পন্ন , বিজ্ঞানমনস্ক , আত্মবিশ্বাসী , দক্ষ , সৃজনশীল ও সুখী একটি প্রজন্মতৈরির লক্ষ্যে রূপকল্পটি নির্ধারিত হয়েছে । 

যে প্রজন্ম স্বকীয়তা বজায় রেখে অপরের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার পাশাপাশি সমাজের ধর্ম- বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণআচরণ ও শান্তিপূর্ণসহাবস্থানে সচেষ্ট হবে । সৃজনশীলতা ও রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার সুফল নিশ্চিত করে উন্নত – সমৃদ্ধবাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারবে । এছাড়াও বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে আত্মপরিচয়ের বহুমাত্রিকতাকে স্বাগত জানিয়ে অভিযোজনে সক্ষম বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে ।

অভিলক্ষ্য

শিক্ষার মাধ্যমে এ রূপকল্প অর্জনে বাংলাদেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে । এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম এবং তার বাস্তবায়নে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কিছু কৌশলগত বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন নিশ্চিত করা । একটি কার্যকর পরিকল্পনা ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নই এ রূপকল্প অর্জন নিশ্চিত করতে পারে । 

রূপকল্প বাস্তবায়নের অভিলক্ষ্য সমূহ নিম্নরূপ :

  1. সকল শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে কার্যকর ও নমনীয় শিক্ষাক্রম
  2. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীর বিকাশ ও উৎকর্ষের সামাজিক কেন্দ্ৰ
  3. প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ ও স্বীকৃতি
  4. সংবেদনশীল , জবাবদিহিমূলক একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা
  5. শিক্ষাব্যবস্থার সকল পর্যায়েদায়িত্বশীল , স্ব-প্রণোদিত ,দক্ষ ও পেশাদার জনশক্তি

শিক্ষাক্রমে যোগ্যতার ধারণা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধহয়ে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান ,দক্ষতা , মূল্যবোধ , ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতা।

শিক্ষাক্রমের ধারণা ও যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও পরিমার্জনের ক্রমবিকাশ

শিক্ষাক্রম এর দশটি মূল যোগ্যতা

১. অন্যের মতামত ও অবস্থানকে সম্মান ও অনুধাবন করে, প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিজের, মতামত যথাযথ মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করতে পারা ।

২. যেকোনো ইস্যুতে সূক্ষ্ম চিন্তার মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়সমূহ বিবেচনা করে সকলের জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারা ।

৩. ভিন্নতা ও বৈচিত্রকে সম্মান করে নিজন্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও এঁতিহ্যের ধারক হয়ে নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা প্রদর্শন পূর্বক বিশ্ব নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করা ।

৪. সমস্যার প্রক্ষেপণ, দ্রুত অনুধাবন, বিশ্লেষণ, সংশ্রেষণ এবং ভবিষ্যৎ তাৎপর্য বিবেচনা করে সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে ও সমাধান করতে পারা ।

৫. পারস্পারিক সহযোগিতা, সম্মান ও সম্প্রীতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারা এবং পরবতী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারা।

৬. নতুন দৃষ্টিকোণ, ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের মাধ্যমে নতুনপথ, কৌশল ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করে শৈল্সিকভাবে তা উপস্থাপন এবং জাতীয় ও বিশ্বকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারা ।

৭. নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত নিয়ে নিজ অবস্থান ও ভূমিকা জেনে ঝুঁকিহীন নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি করতে ও বজায় রাখতে পারা ।

৮. প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ঝুঁকি ও দূযোগ মোকাবেলা এবং মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন ও জীবিকার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারা ।

৯. পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে দৈনন্দিন উদ্ভূত সমস্যা গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে সমাধান করতে পারা ।

১০.ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন এবং শুদ্ধাচার অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানব- কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারা ।

উপরোল্লেখিত যোগ্যতাসমূহ অপরিবর্তিত রেখে প্রাথমিক স্তরের উপযোগী যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।

Advertisement

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *